সান্তাহারে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার ভাবনা শুরু হয়েছিল ১৯৬৩ সাল থেকে। সান্তাহার থেকে বগুড়া, জয়পুরহাট, নাটোর ও নওগাঁ পর্যন্ত মাঝে আর কোন কলেজ ছিল না। কৃষিনির্ভর পশ্চাৎপদ এতদাঞ্চলে বিশেষ করে গরীব ছাত্র/ছাত্রীদের জন্য উচ্চ শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সান্তাহারে একটি কলেজের প্রয়োজনীয়তা তাই গুরুত্তের সঙ্গে অনুভূত হয়েছিল। অনেক ত্যাগ, তিতিক্ষা ও শ্রমের বিনিময়ে ১৯৬৭ সালে সান্তাহার ইন্টারমিডিয়েট কলেজ নামে প্রতিষ্ঠিত সেই কলেজটি পরবর্তীতে সান্তাহার ডিগ্রী কলেজ হিসাবে এ অঞ্চলে শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিকাশে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে।
সেই সময়ে সান্তাহার ছিল বগুড়া জেলায় দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। রেলওয়ে জংশন স্টেশনকে কেন্দ্র করে এ শহরটির উৎপত্তি বিংশ শতাব্দির প্রথম দশক থেকে। অন্যতম বড় রেলওয়ে ট্র্যান্সশিপমেন্ট ইয়ার্ডের জন্য সান্তাহার সমগ্র ভারতে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। শহর জীবনের প্রয়োজনে এখানে বাজার ঘাট বসতবাড়ি উন্নত হয়ে গড়ে উঠেছিল। তেমনই উন্নয়নের জন্য শিক্ষার চাহিদা থেকেই এখানে পঞ্চাশের দশকে চারটি বালক উচ্চ বিদ্যালয় ও একটি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। জেলা প্রশাসনের নৈকট্য থেকে অনেক দূরে জেলার শেষ পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত সান্তাহারে রাজনৈতিক নেতৃত্ব তেমন সবল সমৃদ্ধ হতে পারে নাই। নিয়মিত বন্যার প্রকোপে খাদ্যঘাটতি ও দুর্ভিক্ষজনিত কারণে গোটা অঞ্চলটি অর্থনৈতিক ভাবে পশ্চাৎপদ হয়েছিল। উচ্চবিদ্যালয় গুলোর কারণে প্রতি গ্রামে ম্যাট্রিকুলেশন পাস ৮/১০ জন ছিলেন। কিন্তু গ্রাজুয়েট, পোস্টগ্রাজুয়েট, উকিল, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার আদমদীঘি থানায় ১৪/১৫ জনের বেশি ছিল না। তাই একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার দাবি প্রায়শ: উত্থাপিত হয়েছে। ১৯৬৩ সালে ও পরে ১৯৬৫ সালে দুবার সান্তাহার কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েও তা ব্যর্থ হয়ে যায়।
এখানে একটি বিষয় উল্যেখযোগ্য ষাটের দ’শকে এদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ যখন ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি,শিক্ষা, শিল্প ও অর্থনীতি সম্পর্কে বাঙলির বঞ্চনা নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে, তখন আদমদীঘি-সান্তাহার অঞ্চলের শিক্ষিত যুবসমাজও জেগে উঠেছিল। ওই সমস্ত শিক্ষিত যুবকদের উদ্যোগে গোটা পশ্চিম বগুড়া অঞ্চলে সামজিক তথা-প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতৃত্ব সৃষ্টির লক্ষে “পশ্চিম বগুড়া কর্মী শিবির” নামে একটি সমাজ কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান যাত্রা শুর” করে ১৯৬৫ সালে। পূর্বদিকে দুপচাঁচিয়া, উত্তরদিকে পাঁচবিবি পর্যনত্ম অনেক সদস্য ও শুভাকঙ্খী ছিল এই কর্মী শিবিরে। নির্বাহী কমিটিতে দায়িত্বে ছিলেন সভাপতি জনাব মসিহউল ইসলাম, এ্যাড.ঢাকা হাই কোর্ট, তিনজন সহ-সভাপতি সর্বজনাব ফরেজ উদ্দিন আহম্মেদ, ডা: মহসিন আলী মলিস্নক, আনোয়রম্নল হক সওদাগর, সাধারণ সম্পাদক জনাব তাহের উদ্দিন সরদার, সহকারী সম্পাদক জনাব মোঃ সৈয়দ আলী, সদস্য, সর্বজনাব কছিম উদ্দিন আহম্মেদ, মো. মোসলেম উদ্দিন প্রাং, মো: মোসত্মাফিজুর রহমান, মো: আজিজুল হক, আহমেদ ফয়েজ ও আরও কয়েকজন। ১৯৬৫ সালের ৩০ অক্টোবর সকাল ১০টায় সানত্মাহার রেলওয়ে ইনস্টিটিউটে বিপুল উৎসাহে পশ্চিম বগুড়া কর্মী শিবিরের বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল। সম্মেলনে উন্নয়নমূলক ২৩ দফা প্রসত্মাব গৃহিত হয়। তার মধ্যে প্রথম দফা ‘সান্তাহার কলেজ’ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব অত্যন্ত আনন্দ উল্যাসের মধ্যে গৃহিত হয়েছিল। এখান থেকেই সান্তাহার কলেজ প্রতিষ্ঠার সূত্রপাত।
প্রস্তাবিত সান্তাহার কলেজ অর্গ্রানাইজিং কমিটিতে নিম্নলিখিত ০৯ জন নির্বাহী সদস্য ছাড়াও শতাধিক সদস্য ছিলেন।
১। সভাপতি- জনাব মোঃ লতিফুল বারী জেলা প্রশাসক, বগুড়া।
২। সহ-সভাপতি- জনাব আলহাজ্ব মোঃ আব্দুল মজিদ তালুকদার- চেয়ারম্যান, ছাতিয়ানগ্রাম, ইউ.পি।
৩। সেক্রেটারি- জনাব মো : মহসিন আলী মল্লিক, চিকিৎসক, সান্তাহার।
৪। সহ-সেক্রেটারী- জনাব মোঃ ফরেজ উদ্দিন আহমেদ এমএ, বি.এড. প্রধান শিক্ষক কলসা আহসান উল্লাহ ইনস্টিটিউট।
৫। নির্বাহী সদস্য- জনাব মোঃ তাহের উদ্দিন সরদার এম.এ- সহকারী শিক্ষক, বি.পি.উচ্চ বিদ্যালয়, সান্তাহার।
৬। ,, ,, কছিম উদ্দিন আহমেদ বি.এস.সি বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, সান্তাহার।
৭। ,, ,, মোঃ মোসলেম উদ্দিন প্রাং, এম.এ- বিশিষ্ট সমাজকর্মী, সান্তাহার।
৮। ,, ,, মোঃ মোসত্মাফিজুর রহমান এম.এ- বিশিষ্ট সমাজকর্মী, সান্তাহার।
৯। ,, ,, মোঃ আহমেদ ফয়েজ এম.এ- বিশিষ্ট সমাজকর্মী, সান্তাহার।
উপরি উল্লিখিত সদস্যবৃন্দ অক্লান্ত পরিশ্রম ও ত্যাগ-তিতিক্ষার দ্বারা জনসাধারণকে অনুপ্রাণিত করে ধনী-দরিদ্র সকলে মিলে সান্তাহার কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগী হয়েছিলেন। ১৯৬৬ সালের প্রথম ছয় মাস সময় বিভিন্ন মহলে যোগাযোগ ও মতবিনিময় কাজ শেষ হল। জুলাই মাসে সান্তাহারের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী কয়েক জনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য আর্থিক অনুদান চাওয়া হয়। তাঁরা হলেন জনাব নিজাম উদ্দিন, বাবু পোকরমল আগরওয়ালা, বাবু সুগণ চন্দ্র আগরওয়ালা, জনাব সিএ হামিদ। তাঁরা মিলিতভাবে ৭৫০০/- টাকা অনুদান প্রদান করেন। এই চারজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী পরবর্তিকালেও কলেজের সহযোগিতা করেছেন। নিজাম উদ্দিন আহম্মেদ সাহেব কলেজ পরিচলনা পরিষদে দুই টার্মে ৬/৭ বছর সদস্য ছিলেন এবং কলেজ উন্নয়নে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছেন। ধনী সম্প্রদায় হতে আরও বেশী অর্থ প্রাপ্তি সম্ভব নয় এমন ধারণা হওয়াতে কমিটি অর্থ প্রাপ্তির লক্ষ্যে অন্য উপায় অবলম্বন করে। সান্তাহার শহর এবং চারপাশে ৫/৬ মাইল ব্যাপী সাধারণ মানুষের মধ্যে গ্রামে গ্রামে সভা সমাবেশ করে উদ্ধুকরণ আন্দোলন চালানো হয়। সেই সঙ্গে কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য জনে জনে বিশেষ ধরনের রশিদ মূলে নগদ অর্থ, ধান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি সংগ্রহের কাজ চালানো হল। ১৯৬৬ সালে ডিসেম্বর মাসে সান্তাহার বি.পি স্কুল মাঠে ডাকা হল এক জনসভায় সহস্রাধিক মানুষে স্কুল মাঠ ভর্তি। সভাতে অর্থদানের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেল প্রায় ১৭০০০/- টাকা। সর্বনিম্ন ৫/১০ থেকে ১০০/- পর্যন্ত প্রতিশ্রুতি ছিল। এক মাসের মধ্যে এই প্রতিশ্রুতি টাকা থেকে ১১০০০/- টাকা সংগ্রহ করা যায়। এ সময়টি ধান ফসলের মৌসুম। প্রতিগ্রামে গ্রামে সেচ্ছা সেবক ধান সংগ্রহ করেছে এবং বিক্রি করে টাকা পৌঁছে দিয়েছে। প্রতি গ্রামে গ্রামে ৫/৬ জন করে ছাত্র অনুদান সংগ্রহ করেছে। জমি জায়গার জন্য সামর্থবান অনেক ব্যক্তিকে অনুরোধ জানানো হল।
সান্তাহার কলসা নিবাসী প্রাক্তন জমিদার বাবু সুরেন্দ্র নাথ সাহা তাঁর স্ত্রী যরভবানী দাসী, শরীক ভ্রাতা যোগেশচন্দ্র সাহা এবং বাবু জগদীশ চন্দ্র সাহা সংলগ্ন রথবাড়ি নামে খ্যাত ৬৪ শতকজমি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। উচুঁভূমি, যাতায়ত যোগ্য রাস্তাঘাট থাকায় এবং সেখানে একটি মস্তবড় আটচালা ঘর বিদ্যমান থাকায় এই স্থানটি নির্বাচন করা হল। একই সময়ে বড় আখিড়া নিবাসী মোঃ আব্দুল কুদ্দুস মোল্লা সাহেব কামারকুড়ি মৌজায় ৪৬ শতক কৃষি জমি দিতে প্রতিশ্রুতি দেন। উভয় দাতাগণ তাদের উপরিউক্ত জমি কোবালা দলিল মূলে ১৯৬৯ সালে সান্তাহার কলেজের সেক্রেটারি বরাবর হস্তান্তর করেছেন। এর কিছুদিন পরে টিয়রপাড়া মৌজায় কল্যানী রাণী তাঁর ওয়ারিশ সূত্রে প্রাপ্ত ৯৯ শতক জমি কলেজকে রেজিস্ট্রি দানপত্র সম্পাদন করে দিয়েছেন। এ জমি ওয়ারিশগণের সঙ্গে নিস্পত্তি করে দখল আমলে নেওয়া সম্ভব হয় নাই।
রথবাড়ি কলেজ প্রাঙ্গণে মস্তবড় আটচালাতে চারিদিকে দেওয়াল গেঁথে একটি বড় আকারের কক্ষ নির্মিত হল। তাছাড়া আরও কয়েকটি টিনের চালাবিশিষ্ট আধাপাকা কক্ষ নির্মাণ করে অফিস কক্ষ, শ্রেণীকক্ষ, গ্রন্থাগার এবং ছাত্রী বিশ্রাম কক্ষ ইত্যাদি ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ১৯৬৭ সালে মার্চ মাসে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে সান্তাহার ইন্টারমিডিয়েট কলেজ এর এ্যাফিলিয়েশন চেয়ে আবেদনপত্র দাখিল করা হয়েছিল। কলেজসমূহের পরিদর্শক জনাব লুৎফর রহমান মল্লিক কলেজ পরিদর্শন করে গেছেন। কলেজের এ্যাফিলিয়েশন প্রাপ্তি সাপেক্ষে উচ্চ মাধ্যমিক একাদশ শ্রেণীতে ছাত্র ভর্তির অনুমতি দিয়েছেন। বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্যে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে ১৯৬৭-৬৮ শিক্ষাবর্ষে মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগে প্রায় ২৬৯ জন ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করা হয়। ইতোমধ্যে নিম্নবর্ণিত শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগ করা হয়।
১। মোঃ মোসলেম উদ্দিন প্রাং – অধ্যাপক, অর্থনীতি ও ভারপ্রাপ্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা।
২। মোঃ তাহের উদ্দিন সরদার – অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও উন্নয়ন কর্মকর্তা।
৩। মোঃ মোসত্মাফিজুর রহমান – অধ্যাপক, বাংলা।
৪। মোঃ আব্দুল জব্বার – অধ্যাপক, ইংরেজী।
৫। মোঃ নূরম্নল ইসলাম খন্দকার – অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস।
৬। মোঃ আলী আজগর – অধ্যাপক, দর্শণশাস্ত্র।
৭। মোঃ তাহের উদ্দিন সরদার – অধ্যাপক, হিসাব বিজ্ঞান।
৮। মোঃ হাবিবুর রহমান – গ্রন্থাগারিক।
৯। আহম্মেদ ফয়েজ – করণীক ও আদায়কারী।
১০। মোঃ খয়বর আলী মলিস্নক – দপ্তরী ।
১১। মোঃ আমীর উদ্দিন প্রামানিক – দপ্তরী।
১২। মোঃ হায়দার আলী – প্রহরী।
১৯৬৭ সালের আগস্ট মাসে কোন এক শুভদিনে সান্তাহার ইন্টারমিডিয়েট কলেজের শ্রেণীশিক্ষা কার্যক্রম আরম্ভ করা হয়েছিল। ১৯৬৮ সাল ১ম বর্ষ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদেরকে পরীক্ষার আবেদন পত্র ফিসসহ রাজশাহী রোর্ডে জমা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তখনও এ্যাফিলিয়েশন মঞ্জুর হচ্ছে না। পূর্ব পাকিস্তান গভর্নরের সম্মতিক্রমে এ্যাফিলিয়েশন দেওয়ার বিধান জারি হয়েছে। দুঃখের বিষয় ১৯৬৭ সালের কলেজ গুলোর জন্য গভর্নর বাহাদুরের সম্মাতিপত্রে সান্তাহার ইন্টারমিডিয়েট কলেজ নেই। সেন্টআপ ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে দারুন উৎকণ্ঠা। শিক্ষাবোর্ডের বিশেষ অনুমতিতে নওগাঁ বি.এম.সি কলেজে পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি পাওয়ার বিষয়টি আপতত সমাধান হয়েছিল। পরবর্তীতে নরসিংদী কলেজের উপাধ্যক্ষ মোঃ রোসত্মম আলী দেওয়ান কে অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দান করা হয়েছিল। তিনি ইসলামিক স্টাডিজ ও উর্দু বিষয়ে ডবল এম.এ। বাঙালি ও বিহারি ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য অর্থাৎ উভয় ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে যোগাযোগ ও সম্পর্ক সৃষ্টিতে সুবিধা হবে বিবেচনায় তাঁকে নির্বাচন করা হয়েছিল। তিনি ১৯৬৮ সালে সম্ভবত শেষদিকে সান্তাহার কলেজে অধ্যক্ষ হিসাবে যোগদান করেন। পূর্ব-পাকিস্তানের গভর্নর আব্দুল মোমেন খাঁন ১৯৬৮ সালে ট্রেনযোগে উত্তরবঙ্গ সফরে আসেন। সানত্মাহার স্টেশানে ছাত্র-শিক্ষকসহ সানত্মাহারবাসী সংবর্ধনা জানান। তিনি আমাদের দাবি-দাওয়া শুনে কলেজে বিজ্ঞান শাখা খুলতে বলেন। ১৯৬৮ শিক্ষাবর্ষে বিজ্ঞান বিভাগ চালু হয় এবং শিক্ষাবোর্ড হতে কলেজের এ্যাফিলিয়েশন পাওয়া যায়। ১৯৬৮-৬৯ শিক্ষাবর্ষে বিজ্ঞান বিভাগে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীববিদ্যা ও অংক শাস্ত্র বিষয় চালু করা হয়। বিষয়গুলোর জন্য ০৪ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। এভাবে সানত্মাহার কলেজে সার্বিক কার্যক্রম যথারীতি পরিচালিত হতে থাকে। ১৯৬৯ সালে বাংলাদেশে রাজনৈতিক আন্দোলন উত্তাল হয়ে উঠে। আওয়ামী লীগের ৬ দফা দাবি গণআন্দোলনের আকার ধারণ করে। ১৯৭০ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন করতে দেওয়া হয় নাই। শুরু হল অসহযোগ আন্দোলন। অবশেষে স্বাধীনতা যুদ্ধ। বাঙালি মাত্রই সেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ইতিহাস জানেন। সান্তাহার শহর এবং পাশের গ্রামগুলো এ যুদ্ধে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। সান্তাহার কলেজটিও সেই সাথে ধ্বংস প্রাপ্ত হয়।
সান্তাহার আওয়ামী লীগ সংগ্রাম কমিটি যুদ্ধবিধ্বস্ত সান্তাহারের পুর্নবাসনের উদ্দেশ্যে ২৮.১২.১৯৭১ ইং তারিখে একটি সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, যেহেতু রথবাড়ি প্রাঙ্গণে সান্তাহার কলেজের সমস্ত ঘরবাড়ি ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ায় সেখানে কলেজ চালু করা সম্ভব নয় এবং অবাঙালি ও বিহারি অন্যত্র চলে যাওয়ার মুসলিম হাই স্কুলটি (উর্দু মাধ্যম স্কুল) চালু হওয়ার সম্ভবনা নেই সেহেতু সান্তাহার কলেজটি সাহেবপাড়ায় মুসলিম হাই স্কুলে স্থানান্তর করা হোক। অধ্যক্ষ মোঃ রোসত্মাম আলী দেওয়ান কলেজে না আসা পর্যনত্ম অধ্যাপক মোঃ মোসলেম উদ্দিন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসাবে কলেজ পরিচলনা করবেন।
পরিত্যক্ত মুসলীম হাই স্কুলটিতে সান্তাহার কলেজ স্থানান্তরের জন্য বগুড়া জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিয়ে কলেজের পুনর্বাসন ও শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হয়। সান্তাহারের নেতৃস্থানীয় সকল মহল, বিশেষ করে সংসদ সদস্য জনাব কছিম উদ্দিন আহম্মেদ সাহেবের একনিষ্ঠ সাহযোগিতায় সান্তাহার কলেজটি দ্রুত পুনর্বাসিত হতে থাকে। খুব অল্প সময়ে ন্যূনতম প্রয়োজনীয় যা কিছু সংগ্রহ করে ১৯৭২ সালের জানুয়ারী মাসের শেষদিকে শ্রেণী শিক্ষণ কাজ শুরু করা সম্ভব হয়েছিলো। ১৯৭২-৭৩ শিক্ষাবর্ষে ডিগ্রী পর্যায়ে বিএ ও বিকম কোর্স চালু করা হয়। শিক্ষকও নিয়োগ দান করা হলো। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় হতে ডিগ্রী কোর্সের অনুমোদন প্রক্রিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিষ্ট্রার যে সহযোগিতা দেন তা আজও স্মৃতিতে অম্লান। যথারীতি কলেজ পরিচালনা পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুসারে কলেজের নাম ফলকে সান্তাহার ইন্টারমিডিয়েট কলেজ এর পরিবর্তে ‘সানত্মাহার ডিগ্রী কলেজ’ লেখা হলো। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে স্নাতক শিক্ষাদানের গৌরব মুকুট মাথায় পরে সান্তাহার কলেজ আরও একধাপ এগিয়ে গেলো।
অধ্যক্ষ মোঃ রোসত্মম আলী দেওয়ান মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীতে কলেজে না আসায় জনাব মোঃ মোসলেম উদ্দিন প্রাং কে অধ্যক্ষ হিসাবে নিয়োগ দান করা হয়।
অবলুপ্ত মুসলিম হাইস্কুলটি ১৯৬০ সালে সানত্মাহারে বসবাসকারি অবাঙালি ও বিহারি জনগোষ্ঠির জন্য সানত্মাহার সাহেব পাড়ায় একর ২.৫০ রেলভূমিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। সানত্মাহার ডিগ্রী কলেজের জন্য ঐ ২.৫০ একর জমিসহ প্রাঙ্গণের পশ্চিম পার্শ্বের বর্তমানে অব্যবহৃত এবং ভবিষ্যতে রেলের ব্যবহারের সম্ভাবনা নেই এমন আরো ১৩.১৩ একর জমি সর্বমোট ১৫.৬৩ একর রেলভূমি অস্থায়ী পত্তনি লাইসেন্স রেলওয়ের কেন্দ্রীয় প্রশাসন হতে দেওয়া হয়। এসব জমি পার্শ্ববর্তী গ্রামের লোকদের চাষাবাদে দখলে ছিলো। তারা তাদের বাড়ির দুয়ারে একটি ডিগ্রী কলেজ পাওয়ার গর্বে জমির দখল ছেড়ে দিয়ে শিক্ষানুরাগের দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। ভবিষ্যৎ উন্নয়ন ও কলেজের পরিসর বাড়ানোর সম্ভাবনাকে দূরদৃষ্টিতে রেখে এসব ভূমি সংগ্রহের প্রয়াস ও সফলতা এগিয়ে যাওয়ার আরেকটি মাইল ফলক বলা যায় নিঃসন্দেহে।
উচ্চ মাধ্যমিক গবেষনাগারটি ছিলো ছোট টিনশেডে। ঘর্মাক্ত কলেবরে ছাত্র-শিক্ষক ব্যবহারিক ক্লাস করত। বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি পর্যাপ্ত ছিলো না। তৎকালীন সংসদ সদস্য জনাব কছিম উদ্দিন আহম্মেদ সাহেবের সুপারিশে এবং বাণিজ্যমন্ত্রী কামরুজ্জামানের বিশেষ অনুমোদনক্রমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গবেষণাগার ও বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ক্রয়ে শুল্কমুক্ত পঞ্চাশ হাজার টাকার একটি আমদানি লাইসেন্স কলেজ কর্তৃপক্ষকে দেয়া হয়। তখন নগদ মূল্যে আমদানী করার সামর্থ ছিলো না। কিন্তু সানত্মাহরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী জনাব নিজাম উদ্দিন সাহেবের জিম্মাদারিতে পূবালি ব্যাংকের ঋণ সুবিধা নিয়ে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতিগুলো ইংল্যান্ড, জাপান, ভারত ও হাঙেরি থেকে আমদানি করা সম্ভব হয়েছিলো। ১৯৭৪ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যনত্ম সময় কালে সরকারি অর্থানুকূল্যে পাকা দ্বিতল বিজ্ঞান গবেষণাগার নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়। ১৯৭৮ সালে কৃষি বিজ্ঞান বিভাগের কার্যক্রম চালু করা হয়। ইতোমধ্যে স্নাতক বিজ্ঞান গবেষণাগার সজ্জিত করে ১৯৮৪-৮৫ শিক্ষাবর্ষে কলেজে বিএসসি পাস কোর্স প্রবর্তিত হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি পাস কোর্সের অনুমোদন পাওয়া যায়। সময়ের প্রয়োজনে একটি ডিগ্রী কলেজ উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে মানবিক, বাণিজ্য ও বিজ্ঞান বিভাগসহ পূর্ণাঙ্গ হলো।
বিজ্ঞান শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে কলেজে বিদ্যুৎ সংযোগ অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে। বিজ্ঞান গবেষাগারে গ্যাস মেশিন, পানির পাম্প মেশিন, পানি বিশুদ্ধকরণ মেশিন ও বিজ্ঞান যন্ত্রপাতি চালানের জন্য বিদ্যুৎ চাই। অফিস কক্ষে, গ্রন্থাগারে, শ্রেণী কক্ষে সর্বত্র বিদ্যুৎবিহীন অসহনীয় পরিবেশ সৃষ্টি হয়। রেলওয়ের মধ্যে পিডিবির বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নেই। রেলওয়ের একটি পূর্ণাঙ্গ পাওয়ার হাউজ ছিলো কিন্তু রেলওয়ের বাড়ি, অফিস ছাড়া বিদ্যুৎ সংযোগের আদেশ ছিলো না। সে সময়ে সাহেব পাড়া এলাকায় কলেজই একমাত্র পিডিবির গ্রাহক। তাই বাণিজ্যিক বিবেচনায় পিডিবির এ লাইন নির্মাণে অসম্মতি ছিলো। ১৯৮৪ সালে পিডিবির শিক্ষানুরাগী একজন বিভাগীয় উন্নয়ন কর্মকর্তার সহানুভূতিতে কলেজের বিদ্যুৎ চাহিদার গুরুত্ব বিশেষ বিবেচনায় নওগাঁ রোড থেকে কলেজ পর্যন্ত দীর্ঘ বিদ্যুৎ লাইনটির নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদনের ব্যবস্থা হয়েছিল।
বিভিন্ন সমস্যা ও সংকটের মধ্য দিয়ে কলেজের কার্যক্রম পরিচালিত হতে থাকে। জাতীয়করণ করা ছাড়া কলেজটি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। প্রেসিডেন্ট এরশাদ ইতোমধ্যে কয়েকটি কলেজকে জাতীয়করণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কলেজ পরিচলনা পরিষদ জাতীয়কণের লক্ষ্যে কাজ করতে থাকে। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯৮৮ সালে ৩১শে জানুয়ারী কলেজ মাঠে এক বিশাল জনসভায় প্রেসিডেন্ট এরশাদ সান্তাহার ডিগ্রী কলেজটিকে জাতীয়করণের ঘোষনা দিলেন। ১৯৮৮ সালে ৩১ শে মার্চ হতে সান্তাহার সরকারি কলেজ এর মর্যাদায় পরিচালিত হতে থাকে। বাংলাদেশ সরকারের বরাবরে সান্তাহার ডিগ্রী কলেজের যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পতিসহ রেজিস্টার্ড দলিলমূলে “ডিড-অফ-গিফ্ট” পূর্ন মালিকানা হস্তান্তর করা হয়েছে। কলেজের প্রাঙ্গণস্থ ১৫.৬৩ একর জমি রেলওয়ে থেকে অধিগ্রহণ করে সরকারের ভূমি মন্ত্রণালয়ে গ্রহণ এবং সে জমি সান্তাহার সরকারি কলেজের নামে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রদান করা হয়েছে।এই কলেজটি প্রতিষ্ঠায়, পরিচালনায়, উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় এবং জাতীয়করণ প্রক্রিয়ায় যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে জড়িত ছিলেন তাঁরা সকলেই কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধার সাথে স্মরনীয়।
(লেখাটি-সান্তাহার সরকারী কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ জনাব মোসলেম উদ্দীন এর লেখা হতে সংকলিত)
সান্তাহার ডটকম/মোসলেম উদ্দীন/১৫-০৪-২০১৬ইং
Add Comment