সজল জাহিদ :: কখনো কখনো ট্রেন লেট যে কারো জন্য আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিতে পারে, সেটা জানাই ছিল না। কিন্তু এই ঈদের ছুটিতে সান্তাহার থেকে ঢাকায় ফেরার সময় সহকারী স্টেশন মাস্টারের কাছে জানতে পারলাম অন্তত ৩ ঘণ্টা ট্রেন লেট! আর এ লেটের কারণে দুর্লভ আশীর্বাদের অভিজ্ঞতা হলো!
সেই স্কুলে পড়ার সময় সান্তাহারের একটি বিশেষ জায়গার প্রতি একেবারেই ভিন্ন কারণে আগ্রহ তৈরি হয়েছিল; নাম ‘রক্তদহ বিল’। মনে পড়তেই সামনে এক অটোরিকশাওয়ালা পেয়ে গেলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, এখান থেকে রক্তদহ বিল যেতে-আসতে কত সময় লাগবে?
তিনি জানালেন, যেতে ২০-২৫ মিনিট আর ফিরে আসতেও তেমনই। হিসাব করে দেখলাম, যেতে-আসতে ১ ঘণ্টা এবং সেখানে যদি আরো ১ ঘণ্টা ঘুরেও দেখি, তার পরও স্টেশনে ফেরার পর ১ ঘণ্টা হাতে থাকবে। সুতরাং আর সময় নষ্ট করা নয় কিছুতেই! উঠে পড়লাম।
স্কুলে পড়ার সময় থেকেই আমার তুমুল আগ্রহ, একদিন সময় পেলে রক্তদহ বিল দেখতে যাব। কথা প্রসঙ্গে একদিন বন্ধুদের কাছে সান্তাহারের রক্তদহ বিলের নাম শুনেই কেমন যেন রোমাঞ্চ অনুভূত হয়েছিল।
অনেকের কাছে এ বিলের গল্প শুনেছি, যা গা শিরশিরে অনুভূতির মতোই ভয়াবহ! কথিত আছে, ব্রিটিশ শাসনামলে এ বিলে অনেক মানুষকে কেটে ভাসিয়ে দেয়া হতো নির্জনে! যাদের খবর আর কেউ কোনো দিন পেত না।
একবার নাকি এক ব্রিটিশ ও স্থানীয় জমিদারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের খবর পেয়ে সেই রাজা আর ব্রিটিশ মিলে বহু মানুষকে একত্রে এ বিলের জলে কেটে ভাসিয়ে দেয়! এত মানুষকে একসঙ্গে কাটা হয়েছিল যে, পুরো বিলের পানি রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল! পুরো বিলের সেই রাঙা পানি দেখে মুখে মুখে বিলটির নাম হয়ে গিয়েছিল ‘রক্তদহ বিল’! এ মিথ বা গল্প শোনার পর থেকে বিলটি দেখার আগ্রহের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে এর সঙ্গে মিশে থাকা সত্য বা মিথ্যা ইতিহাস। তবে যখনই মনে পড়েছে এ রক্তদহ বিলের কথা, রোমাঞ্চিত হয়েছি বারবার।
আহ! চলার শুরুতেই একরাশ মুগ্ধতা আর অপার সৌন্দর্যে বিমোহিত। শুরুতেই বড় একটা দীঘির মাঝ দিয়ে রেলস্টেশন লাগোয়া রাস্তা। একদম টলটলে পানি, ঝিরঝিরে বাতাসে শরীর-মন দুই-ই জুড়িয়ে গেল। এরপর আমার চিরাচরিত ভালো লাগার পথ আর দুধারের অপরূপ দৃশ্য। আঁকাবাঁকা পিচঢালা মিহি পথের দুই সবুজের আস্তরণ আর মাঝে মধ্যে লাল ইটের তৈরি ব্রিটিশ আমলের রেল কলোনির সরকারি বাসভবন।
বাঁকা পথ, সবুজ প্রান্তর আর পুরনো রেল কলোনি পার হতেই আমাদের ব্যাটারি বাহন উঠে পড়ল নওগাঁ-বগুড়া বাইপাস সড়কের চওড়া পিচঢালা পথে। এর দুইপাশে তালগাছের সারি, যেন অদ্ভুত সুন্দর সাজে আকাশ ছুঁতে চাইছে!
কিছুক্ষণ পরই অপরূপ এ পথ ছেড়ে কাঁচা রাস্তায় চলতে শুরু করল আমাদের অটোরিকশা। দুপাশে সবুজ গাছ, ধান ক্ষেতের সবুজ প্রান্তর আর একটু দূরেই চোখে পড়ল অনেক অপেক্ষার সেই রক্তদহ বিল। চালক জানালেন, দূরের যে জলাশয় দেখা যাচ্ছে, সেটিই রক্তদহ বিল!
শোনা মাত্র চোখ তুলে তাকাতেই কেমন যেন একটা রোমাঞ্চ অনুভব করলাম নিজের ভেতর। একটা অস্থিরতা বা ছটফটানি অনুভূতি! অটোরিকশা যেন আগের চেয়ে ধীর হয়ে গেছে, কোথাও কাদাপথে নেমে যেতে হয়েছে। শেষে অস্থির চিত্তের আমি নেমেই গেলাম অটোরিকশা থেকে। হেঁটে যেতে যেতে মনে হলো, অটোরিকশার চেয়ে হেঁটেই আগে যেতে পারব। আর তা-ই করলাম। দুইপাশের শান্ত জলাশয়, মিহি ধানক্ষেত, ছোট সেচের আইল, মেঠো পথ পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম কাঙ্ক্ষিত সেই রক্তদহ বিলের শুরুতে।
বেশক’টি বটগাছের ছায়ায় মাখামাখি কাঁচা রাস্তার শেষ প্রান্তে পৌঁছতেই চোখে পড়ল সাইনবোর্ড—রক্তদহ বিলের পরিচিতি। বিশাল আয়তনের এক জলাশয়, যা নওগাঁ, বগুড়া হয়ে ছুঁয়ে গেছে দেশের বিখ্যাত চলন বিলের সঙ্গে। যতদূর চোখ যায়, শুধু টলটলে জলের সমারোহ, মাঝে মধ্যে গুচ্ছগ্রামের মতো কয়েকটি বাড়ি নিয়ে কারো কারো আবাস, নৌকায় বেড়াতে আসা ছেলেমেয়েদের ভেসে বেড়ানো, হালকা ঢেউয়ের দোল খেয়ে চলেছে সবাই। টলটলে স্বচ্ছ জলের মাঝে সবুজ কচুরিপানার দল, জলজ গুল্মলতা, মাছের আনাগোনা, দু-একটি সাপের জলের মধ্যে নিজের মতো করে ছুটে চলা।
অনেক দিন পর চোখে পড়ল মাছরাঙা পাখি। ঝুপ করে জলে ডুব দিয়ে ঠোঁটে তুলে নিল নিজের আহার একটি রুপালি মাছ! আমার ছেলে তো এ দৃশ্য দেখে যারপরনাই অভিভূত! আকাশে উড়তে থাকা একটি রঙিন পাখি কীভাবে পানির মধ্যে ডুবে মাছ লুফে নিতে পারে! ওর সেই বিস্ময় কাটাতে হয়েছে অনেক কিছু দিয়ে, পুরনো স্মৃতি আর নানা গল্পে বুঝিয়ে।
এরপর বটের ছায়া, ওর শিকড় ধরে নেমে গেলাম বিলের জলের শীতল স্পর্শ পেতে, সবুজ কচি ঘাসের কোমলতার স্বাদ নিতে, মাটির সোঁদা গন্ধ নিতে, জল-কাদার সুখ ছুঁতে আর ঝিরঝিরে বাতাসের মিহি পরশ পেতে। নরম ঘাসের ওপর বসে, ঝিরঝিরে বাতাস গায়ে মাখতে মাখতে পা ডুবালাম রক্তদহ বিলের স্বচ্ছ জলে। কী অদ্ভুত এক আনন্দে শিহরিত হলাম! বলে বা লিখে বোঝানোর মতো নয় আদৌ। যেদিকেই চোখ যায়, শুধু পানি আর পানি, কোথাও কচুরিপানার সবুজ জটলা, কোথাও জেলেদের মাছ ধরা ডিঙির দোল, কোথাও দূরের গুচ্ছগ্রামে হাঁস, গরু, ছাগলের মায়াবি ডাক।
অসময়ে কি কোকিল ডেকে গেল কোনো? কানে তো তেমন করেই কোকিলের কুহুতান ভেসে এল বুঝি! নীল আকাশজুড়ে কয়েকটি চিলের উড়ে চলা দেখে ছেলে অবাক হয়ে আবারো নানা প্রশ্ন জুড়ে দিল। একই সঙ্গে তার ইচ্ছা—নৌকায় করে দূরের কোনো সবুজ গ্রামে যাবে ঘুরতে। দারুণ কৌতূহল ওর, কেন আর কীভাবে এ বিলের নাম রক্তদহ বিল হলো? ওকে শোনালাম নিজের কাছেই বিস্ময় লাগা রক্তদহ নামকরণের সেই গল্প! শুনে দারুণ রোমাঞ্চিত। তার অজস্র প্রশ্ন, এখনো কি কেউ ডুবে আছে রক্তদহ বিলে!
এরপর হাঁটতে শুরু করলাম বিলের আইল ধরে। আইল হলো বিলের মাঝে হাঁটার ছোট ছোট ক্ষীণ পথ, যা বেশি দূর এগোয়নি। কিছুদূর গিয়েই পথের শেষ নেমে যায় পানির মাঝে বা বিলের জলে। সেই আইলের দুইপাশে তাল, খেজুরসহ নানা বনজ আর জলজ গাছ সবুজ করে রেখেছে চারপাশ। এসব গাছে ও ঘাসে উড়ে এসে বসছে, আসা-যাওয়া করছে আর নিজের মতো করে খেলছে নানা রঙের ফড়িং ও কীটপতঙ্গ। সে এক অবাক বিস্ময়। নানা প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিল ছেলে।
চারপাশের এ বিশুদ্ধ, কোমল আর স্বচ্ছ জলাশয়, মিহি ঘাসের নরম স্পর্শ, টলটলে জলের শীতল পরশ, ইচ্ছা করেই কাদায় একটু মাখামাখি, কাছে-দূরের সবুজ গ্রামের হাতছানি, অসময়ে কোকিলের কুহুতান, আকাশে উড়ে চলা গাঙচিল, ঝিরঝিরে বাতাসের কোমল পরশ, মাটির কাঁচা রাস্তার ধুলোময় পথ, ঘাটে বাঁধা ও ভেসে চলা ডিঙি নৌকা, জেলেদের মাছ ধরা, বিভিন্ন গাছে আচ্ছাদিত মেঠোপথের অপার সুখে ভেসে ভেসে, দেখে দেখে, হেঁটে হেঁটে অবশেষে চলে এলাম আমাদের অটোরিকশার কাছে। সূত্র: বণিকবার্তা
সান্তাহার ডটকম/ইএন/২৮ জুন ২০১৯ইং
Add Comment