দৈনিক সান্তাহার

সান্তাহার বাফার গুদামের সার গেল কই?

santahar BAFARসান্তাহার ডেস্ক:: ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দাবি করছে, তারা গুদামে সার পৌঁছে দিয়েছে। কিন্তু গুদামে সেই সারের হদিস পাওয়া যায়নি। এ-সংক্রান্ত নথিও পাওয়া যাচ্ছে না। তদন্ত শুরু হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, নথি উইপোকায় খেয়ে ফেলেছে। তদন্ত দল তাদের প্রতিবেদনে অনিয়ম শনাক্ত করে বলেছে, যে সারের হদিস নেই, তা আসলে গুদামে প্রবেশই করেনি। ঠিকাদার ও কর্মকর্তাদের যোগসাজশে প্রায় ২০ কোটি টাকার সার লোপাট হয়েছে। ঘটনাটি ঘটেছে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) অধীন সান্তাহার বাফার গুদামে।
Screenshot_1দেশে কৃষকদের জন্য সার উৎপাদনের পাশাপাশি ঘাটতি পূরণে সার আমদানি করে থাকে বিসিআইসি। দেশের ২৪টি বাফার গুদামে এসব সার সংরক্ষণ করা হয়। আমদানি করা সার গুদাম পর্যন্ত পরিবহন করা হয় বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। পরিবহনের সময় নানা রকম অনিয়মের ঘটনা ঘটে বলে নিয়মিত অভিযোগ ওঠে।
বিসিআইসির কর্মকর্তারা জানান, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সান্তাহার বাফার গুদামে সার পরিবহন নিয়ে অনিয়ম উদ্‌ঘাটিত হয়েছে। পরিবহন ঠিকাদার মেসার্স ডেল্টা শিপিং অ্যান্ড ট্রেডিং ৮ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন সার গুদামে পৌঁছে দেওয়ার বিল জমা দিয়ে ৬ হাজার মেট্রিক টন পরিবহনের বিল তুলে নিয়েছে। অথচ গুদাম কর্তৃপক্ষ বিসিআইসি কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেছে, তারা প্রায় ৪ হাজার (৩ হাজার ৮৮৯.৫৫) মেট্রিক টন সারের কোনো হিসাব পাচ্ছে না। বিসিআইসির তদন্ত কমিটি অনুসন্ধানের পর প্রতিবেদনে বলেছে, গুদামে যে সার ঢোকেনি, সে বিষয়ে তারা নিশ্চিত। তদন্ত কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে বলেন, তদন্তে নেমে তাঁরা নথিপত্রে বড় ধরনের ঘাপলা পেয়েছেন। পণ্যপ্রাপ্তি স্বীকার-সংক্রান্ত রসিদ (এমআরআর) বইয়ের ৫৯টি পৃষ্ঠা গায়েব হয়ে গেছে। এর কারণ জানতে চাইলে রসিদ বই উইপোকায় খেয়ে ফেলেছে বলে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।
২০১৬ সালের মার্চ মাস থেকে মেসার্স ডেল্টা শিপিংয়ের কাছ থেকে সারের চালান গ্রহণ করার সময় এই গুদামের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ইনচার্জ) ছিলেন নবির উদ্দিন। এরপর গত বছরের এপ্রিলে তিনি অবসরে চলে যান। যাওয়ার সময় ওই গুদামের হিসাব কর্মকর্তা মাসুদুর রহমানকে কাগজপত্র বুঝিয়ে দেন। কিন্তু অনিয়ম আবিষ্কার হওয়ার পর এ বছরের জানুয়ারিতে তদন্ত কমিটি মাঠে নামলে মাসুদুর রহমান কমিটিকে বলেন, এমআরআর বইয়ের গায়েব হওয়া ৫৯টি পৃষ্ঠা তিনি নবির উদ্দিনের কাছ থেকে বুঝে পাননি। তখন নবির উদ্দীন তাঁকে বলেছিলেন, রসিদ বইয়ের ওই পৃষ্ঠাগুলো উইপোকায় খেয়ে ফেলেছে। জানতে চাইলে মাসুদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাকে গুদামের পূর্ববর্তী ইনচার্জ বলেছেন, পণ্যপ্রাপ্তি স্বীকারের রসিদ উইপোকায় খেয়েছে। তবে আমি নিশ্চিত ঠিকাদারের সঙ্গে যোগসাজশে সাবেক ইনচার্জ এসব করেছেন। এখন তিনি মিথ্যা বলছেন।’
এদিকে নবির উদ্দিন তদন্ত কর্মকর্তাদের বলেছেন, বইয়ের ৫৯টি পৃষ্ঠা তিনি দায়দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার সময় গুদামের হিসাব কর্মকর্তা মাসুদুর রহমানকে দিয়ে এসেছেন। তিনি কোনো নথি অফিস থেকে নেননি। তবে কিছু নথি উইপোকায় খেয়েছে। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে নবির উদ্দিনকে দফায় দফায় টেলিফোন করা হলে তিনি বলেন, তিনি যেহেতু ওই প্রতিষ্ঠানে আর কাজ করছেন না, তাই এ বিষয়ে তার কোনো বক্তব্য নেই। সার পরিবহনকারী ঠিকাদার মেসার্স সাউথ ডেল্টা শিপিং অ্যান্ড ট্রেডিং লিমিটেডের নির্বাহী কর্মকর্তা মশিউর রহমান প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, তাঁরা গুদামে ঠিকমতোই সার সরবরাহ করেছেন। সারের প্রাপ্তি স্বীকার করে গুদামের কর্মকর্তার স্বাক্ষর করা চালান রসিদ আছে তাঁদের কাছে। মশিউর রহমান বলেন, ‘সার গুদামে না ঢোকালে চালান এল কোথা থেকে? আমরা সার তৎকালীন ইনচার্জের কাছে বুঝিয়ে দিয়েছি। এখন বিসিআইসির কর্মকর্তারা কোথায় কী করেছে তা আমার জানা নেই।’
বাফার গুদামের বর্তমান ইনচার্জ আবদুল মালেক বলেন, সান্তাহার বাফার গুদামের সারের মজুত, ঠিকাদারের সারের পণ্যপ্রাপ্তি স্বীকারপত্র এবং লগ বুকে লিপিবদ্ধ সারের পরিমাণে অসামঞ্জস্য রয়েছে। বিসিআইসির উপব্যবস্থাপক (প্রশাসন) রেজাউল করিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি চলতি বছরের ২ মার্চ তাদের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে কর্তৃপক্ষের কাছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারের প্রাপ্তি স্বীকার করে দেওয়া চালান রসিদে তৎকালীন বাফার ইনচার্জ নবির উদ্দিনের স্বাক্ষরেও অনিয়ম পাওয়া গেছে। কমিটি বলছে, চালান রসিদগুলোর স্বাক্ষর নবির উদ্দিনের নয়। তবে নবির উদ্দিন দাবি করেছেন, এগুলো তাঁরই স্বাক্ষর। কমিটি তাদের প্রতিবেদনে সার লোপাট হওয়ার এ ঘটনায় তৎকালীন ইনচার্জ নবির উদ্দিন ও হিসাব কর্মকর্তা মাসুদুর রহমানকে দায়ী করেছেন। এসব বিষয়ে তদন্ত কমিটির সদস্য বিসিআইসির সহকারী হিসাব কর্মকর্তা রাশেদ নিজাম প্রথম আলোকে বলেছেন, টাকার ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে জটিলতা তৈরি হওয়ায় এ বিষয়টি বেরিয়ে এসেছে। গুদামের নতুন ইনচার্জ বিসিআইসি কার্যালয়ে এ নিয়ে অভিযোগ করেন। রাশেদ নিজাম বলেন, ‘আমরা নিশ্চিত হয়েছি যে কোটি কোটি টাকার সার ঢোকেনি। অর্ধেকের বেশি স্বাক্ষরই জাল। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কর্মকর্তারা কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। আমাদের মনে হয়েছে, এমন আরও অনেক ঘটনা রয়েছে সার চুরির। দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা হবে বলে জানান তিনি।’
তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে সদ্য বদলি হওয়া বিসিআইসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইকবাল বলেন, দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সূত্র: প্রথম আলো, ৭ এপ্রিল ২০১৭ শুক্রবার

>> সান্তাহার ডটকম/ইএন/৮ এপ্রিল ২০১৭ইং