গুণীজন

১৯৭১ এর স্মৃতি; আমার বাবার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। পর্ব-২

ইঞ্জিনিয়ার এস, এম রায়হানুল ইসলাম রায়হান :: (গত পর্বের পর) ৩. আমি মো. মোজাহারুল ইসলাম। ১৯৬৮ সালে ১০ম শ্রেণীতে বগুড়ার সান্তাহার বি.পি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছিলাম। এমন সময় ১২ অক্টোবর আমরা পাঁচ বন্ধু মিলে রংপুরে বেড়ানোর উদ্দেশ্যে গিয়েছিলাম। ঠিক পর দিন শুনলাম রংপুর সার্কিট হাউজে সেনাবাহিনীতে যোগ দেবার জন্য বাছাই চলছে। আমি তা শুনে লাইনে দাঁড়াইয়ে গেলাম, ঐ লাইনে ৭০০ জন ছিল সেখান থেকে ১৫ জনকে বাছাই করে আমি টিকে যায়। পরে মেডিকেল রিপোর্টে ৮ জন টিকে সেখানে ও আমি টিকে যাই। পরে আমাদের ৮ জনকে নিয়ে চট্টগ্রামে রওনা হয়। আমি চিঠি লিখে তিস্তামুখ ঘাট গিয়ে একজন ট্রেন ড্রাইভারের হাতে সান্তাহারে আমার মামার দোকানে খবরটা পৌঁছায়। এরপর চট্রগ্রামে নতুনপাড়া ইপিআর (ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট) এর ট্রেনিং সেন্টারে ৬নং প্লাটুন ম্যাধমে ট্রেনিং করি। এর মাঝে আমার বড় ভাই আমার সাথে একবার গিয়ে দেখা করে। এরপর ৬ মাস ট্রেনিং শেষে ১৫ দিনের ছুটিতে বাড়িতে আসি। তারপর ট্রেনিং সেন্টার চট্টগ্রামে যোগ দিই। সেখান থেকে ঢাকা জয়দেবপুর ২নং বেঙ্গল ক্যান্টনমেন্টে পাঠায় এবং সেখানে বি কোম্পানিতে চাকরি জীবনটা শুরু করি।

১৯৭১ সালে মার্চ মাসে ১৭ তারিখে অস্ত্র চেকআপ হয় এবং পরে অস্ত্র জমা দিতে বলে আমরা অস্ত্র জমা দিইনা সেখানেই ফায়ারিং শুরু হয়। পরে আবার ২৩ তারিখে ঐটা মিমাংশা হয়। হঠাৎ করে ২৫ তারিখে বঙ্গবন্ধুকে আটক করে পাকিস্তানে নিয়ে যায়। ঐদিন ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পিলখানা, চট্টগ্রাম নতুনপাড়া ইপিআর ট্রেনিং সেন্টারসহ আর অনেক জায়গায় নিরস্ত্র সেনা সদস্য ও পুলিশের উপর হামলা করে হত্যা করে। তারপর আমাদের ক্যাম্পেও হামলা করে। এই সময় আমরা ক্যাম্পের বাইরে চলে যায়। পরে ঐখানকার ৪৫ জন পাঞ্জাবি অফিসারদের বাঙ্গালি সৈন্যরা মেরে ফেলে। পরবর্তীতে আমরা গাজিপুর অডিনান্স ফ্যাক্টরিতে চলে যায় এবং পরে আমরা রাজেন্দ্রপুর হয়ে নরসিংদীতে আমাদের সামনে পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান ধ্বংস হয়। এরপর আমরা ময়মনসিংহ গিয়ে ময়মনসিংহ কলেজে থাকি ঠিক ঐ সময় পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান আমাদের মাথার উপর ঘুরছিল আমরা সঙ্গে সঙ্গে ফায়ারিং শুরু করি এবং বিমানটি ধ্বংস করে দিই। পরে ঐখান থেকে আসার পর ভৈরববাজার আমাদের সাথে যুদ্ধ হয় আমরা মেঘনা নদী পাড় হয়ে আশুগঞ্জ গিয়ে পাকিস্তানীদের সাথে যুদ্ধ হইলে আমরা জয়ী হই। আমরা ট্রেনে করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছাতেই যুদ্ধ শুরু হয় আমরা ট্রেন থেকে যুদ্ধ করি এবং পাকিস্তানি বাহিনীরা পিছনে চলে যায়। এক রাত থেকে ছাতক চা বাগানে চলে যাই এবং ঐখানে আমাদের চাইনিজ রাইফেল জমা নিয়ে মার্ক থ্রি রাইফেল দেয়া হয়। পরবর্তীতে আমাদের ভারতে আগরতলা হইয়ে পাবর্ত্য চট্টগ্রামে নিয়ে আসা হয় এবং পরবর্তীতে রাউজানে এসে বাঙ্কার করে থাকি। ঐখানে সংগ্রাম পরিশোধ থেকে আমাদের লুঙ্গি গামছা দেয়া হয় এবং খাবারের ব্যবস্থা করে কয়েক দিন পর চট্টগ্রাম ভার্সিটিতে আমরা উঠে গোসল করে রাতে থাকার চিন্তা করছিলাম ঠিক গোসল করছি এমন সময় পাকিস্তান বাহিনী চট্টগ্রাম ভাসির্টি হামলা করে। আমি আর রহমান এই সময় থেকে রাত তিনটা পর্যন্ত বাথরুমেই থেকে যায়। আমরা তখন অস্ত্র হারা হয়ে যায় এবং বাথরুম থেকে বের হয়ে পাহাড়ের ক্যানেল দিয়ে হাটহাজারীতে চলে যায়। সেখান থেকে এক ভাই আমাদের দুইজন নজিরহাট নিয়ে যায় এবং পরদিন নামারহাট হইয়ে আরো কিছু লোক সঙ্গে নিয়ে সীতাকুণ্ড পাহাড় পাড়ি দেয়। এরপর মীরসরাইল গিয়ে পৌঁছাই এবং শুভপুর হইতে ফেনী নদী পাড়ি দিই। পরবর্তীতে নোয়াখালীর একটি বাড়িতে থাকতে হয়। নৌকায় নদী পাড় হইবার সময় আরো তিনজনের সাথে আমাদের পরিচয় হয় এবং এখন আমরা পাঁচ জন হইলাম। পাঁচজনে চৌমুহনী দিয়ে লক্ষীপুর থেকে দুইদিন পর চর ভৈরব যায় এবং একদিন পর তিন নদীর মোহনা নীল কমল ঘাট দিয়ে মাদারীপুর থেকে রাজবাড়ি একদিন থেকে কিছু পায়ে হেঁটে ও নৌকায় করে সুজানগর আসি। ঐখান থেকে দুই জনের বাড়ি পাবনা বেড়া তাদের বাড়ির দিকে চলে যায়। আর একজন বাগাবাড়ী দিয়ে বগুড়া দিকে চলে যায়। আমি আর রহমান এবং রহমানের বাড়ি বরাল ব্রীজ সোনাহারা গ্রামে যায়। আমাকে সেখান থেকে নৌকায় করে মির্জাপুর হাটে পৌঁছাই দেয়। ঐখান থেকে এক মাঝি আমাকে চাটখোর তার বাড়িতে রাখে এবং পরদিন আমাকে রাস্তা দেখাই দেই আমি হাটতে হাটতে ওমরপুর হাটে গিয়ে পৌঁছাই। সেখানে আমাদের গ্রামের দুই ভাই অখিল, দেবনানের সাথে দেখা হয় এবং তারা আমাকে কালিগঞ্জে নিয়ে যাই সেখানে আমার বড় ভায়ের বন্ধু ডা. আহম্মদের বাড়িতে থাকি এবং পরদিন সেখান থেকে আবাদপুকুর হইয়ে আদমদীঘি থেকে পাইকপাড়া হইয়া তিলেকপুর মিজাপুরে গ্রামে বোনের পৌঁছাই।

৪. পরের দিন কয়েক জন মিলে একসাথে ভারতে মধুপুর বাঙ্গালিপুর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে চলে যায়। পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম দিনাজপুর জেলার বালুরঘাট থানার মধুপুরের বাঙ্গালিপুর ক্যাম্প, সেখান থেকে বালুঘাট আব্দুল জলিল ভাইয়ে বাসাই দেখা করতে যায়। পরবর্তী এই আব্দুল জলিল ভাই বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। পরে জলিল ভাইয়ের নির্দেশ ক্যাম্পের বাংলাদেশ থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দেয়ায়। বালুরঘাটে এই নির্জন ছায়াতেই আশ্রয় নিয়েছিল লাখ লাখ শরণার্থী। গড়ে উঠেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে বাংলার লোকেরা দলে দলে সীমান্ত এলাকায় হাজির হচ্ছিল। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের তখন প্রধান দায়িত্ব ছিল এই অসহায় মানুষদের সহায়তা করা ও মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা। নওগাঁ, বগুড়ার, নাটোর জয়পুরহাট, দিনাজপুরের মানুষ এই বালুরঘাট দিয়েই ভারতীয় সীমান্তে প্রবেশ করেছিল।পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম দিনাজপুর জেলার বালুরঘাট থানার মধুপুরের বাঙ্গালীপুর ক্যাম্পের ভারতের অভ্যন্তরেও বালুরঘাট নামে একটি স্থান ও বাজার রয়েছে। এই ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন আব্দুল জলিল ভাই পরবর্তীকালে তিনি হাজার হাজার মানুষের আশ্রয়ের ব্যবস্থা, খাবার ও ওষুধ জোগানো ছিল তার কাজ। ক্যাম্পে যাওয়ার আগে তিনি পুরো অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহ করেছেন। মধুপুর বাঙ্গালিপুর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পটি ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের ৭ নং সেক্টর। আমাদের কমান্ডার ছিলেন কর্নেল নুরুজ্জামান। ভারতের ক্যাপ্টেন রায় সিং আমাদের অপারেশনে নিয়ে যেতে চাই তখন ক্যাম্প ইনচার্জ আমজাত ভাই আমাদের যেতে বলে। ভারতের বর্ডারের কাছে পাগলা দেওয়ানে তুমুলযুদ্ধ হয় সেই অপারেশনে আমরা জয়ী হয়ে ক্যাম্পে ফিরে আসি। একদিন আমাদের কুলপতপুর পাঠায় পিছনে ভারতীয় সৈন্য কোভারিং ফায়ারিং করছিল হঠাৎ পাকিস্তানি সৈন্য আমাদের উপর হামলা করে আমরাও তুমুলযুদ্ধ শুরু করি হঠাৎ হওয়াতে আমাদের বুঝতে সমস্যা হচ্ছিল। সে যুদ্ধটাতে আমরা যুদ্ধ করতে করতে সামনের দিকে আগাতে থাকি এবং পাকিস্তানি সৈন্যরা পিছনের দিকে চলে যায়। যুদ্ধে শামছুল ও আফজাল দারোগা গুলি বিদ্ধ হয়, আর শামছুলকে পাকিস্তানী সৈন্যরা নিয়ে চলে যায় আর আফজাল দারোগাকে আমরা বালুঘাট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

আমাদের মতো আওয়ামী লীগ নেতারা সেদিন ঠিকই বুঝেছিলেন, গেরিলা যুদ্ধ ছাড়া পাকিস্তানি আর্মির মতো একটি শক্তিশালী বাহিনীর বিরুদ্ধে আমরা পারব না। তাই এই উত্তরা অঞ্চল থেকে কৃষক, ছাত্র-জনতাকে সংগ্রহ করে ট্রেনিংয়ে পাঠিয়ে একটা শক্তিশালী মুক্তিবাহিনী তৈরিতেই কাজ করছিলাম। ভারতের বর্ডারের পাশে খরমপুরে বেলঘরীয়া গ্রামে আহম্মাদ মন্ডল সে গোপনে আমাদের সব কথা গুলো পাকিস্তানিদের বলে দিতো আমরা এটা বুঝতে পারি সে রাজাকার ছিল। পরে একদিন তার বাড়িঘর সবগুলো গুড়িয়ে দিই আমরা। নওগাঁ ধামুইরহাট ও পত্নীতলাতে জামাত শিবিরের অনেক লোক ছিল। এই লোকগুলো যুদ্ধ করতে চাইতে না। তারা চাইতো পাকিস্তান থাক এই দেশটা। ঠিক ৭ ডিসেম্বর আমাদের ট্রেনিং দেয়া ক্যাম্পের ৬৭ জনকে জলিল ভাই ভারতীয় ক্যাপ্টেন গুরু দেব সিংয়ের অধীনে চকসুদল চকিলাম খারমপুর বর্ডারে পাঠায়। আমরা তুমুলযুদ্ধ শুরু করি এবং চকচুন্ডি বিওপি আমরা দখল করি এরপর ফাশিপাড়া যায় এবং পরদিন কমলাবাড়ী হইয়ে মাতাজিহাট দখল করি এর পরদিন বদলগাছী হইয়ে কৃত্তিপুর দখল করে নিই। পরদিন শিবপুর থেকে নওগাঁ শহরে প্রবেশ করতে চাইলে পাকিস্তানি সৈন্যদের সাথে সারাদিন ব্যাপী মুহুর্মুহু যুদ্ধ হয় সেই যুদ্ধে আমাদের তিনজন মারা যায়। সে যুদ্ধে আমি ও গুলি বিদ্ধ হই তা পায়ের গোরালিতে ছিল এবং লুতফরকে শিবপুর মোড়ে দাফন করি আর দুই জনে লাশ তাদের বাড়িতে পাঠানো হয়। এরা শাহাদাৎ হোসেন, এচাহাক হোসেন ছিলেন। (চলবে…)

সান্তাহার ডটকম/১৩ জুলাই ২০২০ইং/এমএম