বিবিধ

রাস্তায় ভ্রাম্যমাণ গানপাগল মানুষ

gaan manusঅন্যমনস্কভাবে মোটর সাইকেল বা রিক্সা, ভ্যান বা যে কোনো ধরনের যানবাহনে চড়ে কোথাও যাচ্ছেন হঠাৎ চোখে পরবে বা হঠাৎ কানে ভেসে আসবে সন্ধ্যা মুখার্জী-চন্দন পালঙ্কে শুয়ে একা একা কি হবে জীবনে তোমায় যদি পেলাম না। অথবা শামশাদ বেগমের পুরানো দিনের হারিয়ে যাওয়া গান-লেকে প্যাহলা প্যাহলা পেয়ার, ভরকে আঁখো মে…. চমকে তাকাতেই দেখতে পাবেন ভ্যান গাড়িতে বাজছে এই গানগুলো।
তিনি আকরাম হোসেন সরকার। গ্রাম হলুদঘর, ইউনিয়ন-নশরৎপুর, আদমদীঘি, বগুড়া। পেশায় ভ্যানচালক। তার ভ্যানের সাথেই তিনি দুইটা বাক্স বানিয়ে নিয়েছেন। একটিতে একটি ১২ ভোল্টেজের ব্যাটারি অন্যটিতে পুরাতন মডেলের ন্যাশনাল প্যানাসনিক টেপ রেকর্ডার। সারাদিনই মানুষের বিভিন্ন মালামাল বা মানুষ নিয়ে ছুটে চলেন উপজেলার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। চৈত্রের প্রচন্ড গরমে দরদর করে ঘাম গড়িয়ে পরে শরীর থেকে তার, তারপরেও জীবনের বোঝা টানতে টানতে হাঁপিয়ে ওঠা আকরাম সরকার তার টেপ রেকর্ডারে লতার মুঘল ঈ আযমের-প্যায়ার কিয়া তু ডরনা ক্যায়া, প্যায়ার কিয়া কোই চোরি নেহিথি… গানটিতে সাউন্ড বাড়িয়ে দেন অথবা মাঘের প্রচন্ড শীতে যখন পাখিরাও নীড় থেকে বের হয় না, তখনও শহরের কোনো রাস্তায় বা গাঁয়ের মেঠো পথে কান পাতলেই শোনা যায়, তালাত মাহমুদের-তোমারে লেগেছে এত যে ভালো, চাঁদ বুঝি তা জানে। অথবা বর্ষার বৃষ্টির মাঝেই, হৈমন্তি শুকলার-ও গো বৃষ্টি আমার চোখের পাতা ছুঁয়ো না গানটি।
প্রায় অশিক্ষিত এই মানুষটা ১৯৭৮ সালে যখন ধানের মন ৯১ টাকা তখন কয়েকমন ধান বিক্রি করে তার এই শখের গানের বাক্সটি কিনেন। তার পর বিয়ে, দুটো মেয়ে একটা ছেলে। সামান্য আয়ের সংসারে তাদের ভরন পোষনে হিমশিম খাওয়া গান পাগল এই মানুষটি শেষ সম্বল জমি বিক্রি করে ভ্যান গাড়িটা ক্রয় করেন। গান ছাড়া জীবন চলবে কি করে? এ প্রশ্ন থেকে বাঁচার জন্য তিনি তার জীবিকার মাধ্যমটিতেই যুক্ত করেছেন এই গানের বাক্সটি। সংসার সাগরে হাবুডুবু খাওয়া মানুষটি শত অভাবেও তার টেপ রেকর্ডারটি বিক্রি করেননি। আশ্চর্য্যের ব্যাপার, তার কাছে যে গানের ক্যাসেটগুলো তা সব পুরানো শিল্পীদের। কাননবালা দেবী, শামশাদ বেগম, শচিনদেব বর্মন, মুকেশ, নুরজাহান, মালা, গীতা দত্ত, তালাত, লতা, আশা, মান্না দে, হেমন্ত, শ্যামল মিত্র, রফির গানে সমৃদ্ধ তার সংগ্রহশালা। তার মতে, এই উপমহাদেশে ৮০ দশকের পর তেমন শোনার মত গান সৃষ্টি হয়নি।
প্রশ্ন করেছিলাম, চাচা-চাচি কি গান শোনে? উদাস হয়ে গেলেন কেমন জানি তিনি।
বুঝলাম, বানিয়ার ঘড়েই ধনিয়ার আকাল।
গাড়িতে দুই ড্রাম ডিজেল নিয়ে সান্তাহার থেকে নশরৎপুরেরর দিকে রওনা হন তিনি।
আমি কান পেতে রইলাম-তার পঙ্খিরাজে তখন মান্না দে গাইছে—-আবার হবে তো দেখা, এ দেখাই শেষ দেখা নয় তো….
সান্তাহার ডটকম/সাজেদুল ইসলাম চম্পা/১৫-০৪-২০১৬ইং