গুণীজন

মানবসেবায় আফজাল হোসেন সরদারের পাঁচ যুগ

রায়হানুল ইসলাম :: মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন নীরবে। এলাকার মানুষের পাশে রয়েছেন পাঁচ যুগের বেশি সময় ধরে। তার একান্ত ইচ্ছা এলাকার প্রতিটি ঘরে ঘরে সুখ শান্তি বজায় থাকুক। এলাকার ছেলে মেয়েরা পড়াশোনায় উচ্চশিক্ষিত হয়ে গড়ে তুলুক শিক্ষিত সমাজ, সচল হোক অর্থনীতির চাকা। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে অনেক কিছুই সম্ভব নয়। জনগনের ভালবাসা, জনগনকে নিয়ে পথচলা আর এখন পর্যন্ত তিনি হাঁটছেন, স্বপ্ন দেখছেন, স্বপ্ন বুনছেন মানবসেবার। যা সবসময়ই করে এসেছেন।

সান্তাহার পৌরসভার পাশে নওগাঁ জেলার নওগাঁ সদর থানার বোয়ালিয়া ইউনিয়নের ছোট্ট একটি গ্রাম দোগাছী। ১৯২৭ সালের ৩ মার্চ সেই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আলহাজ্ব মো. আফজাল হোসেন সরদার। বাবা হাজী মৃত জহির উদ্দিন সরদার পেশায় একজন গৃহস্থ পাশাপাশি রেলওয়ে চাকরি করতেন। মা আয়মন বিবি ছিলেন একজন গৃহিনী। উনারা চার ভাই আর এক বোন। উনার বাবার সন্তানের মধ্যে তিনি প্রথম সন্তান।

গ্রামের স্কুল থেকে প্রাথমিক এবং সান্তাহার কলসা আহসানউল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাশ করেছেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি মেধাবী ছাত্র ছিলেন। অল্প বয়সে সংসারের দায়িত্ব নেয়ার কারণে পড়াশোনা বেশি এগিয়ে নিতে পারেননি। সবস্তরেই তিনি শিক্ষকদের অত্যন্ত স্নেহের পাত্র ছিলেন। ছাত্রজীবনে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অনেক পুরস্কারপ্রাপ্ত হয়েছেন। অনেক অনুষ্ঠানের সংগঠক ও পরিচালক হিসাবে বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন।

তার স্ত্রী আমেনা বেগম ও চার কন্যা এবং চার ছেলে নিয়ে তার সুন্দর সাজানো ছন্দময় পরিবার। কিন্তু এই ছন্দময় দাম্পত্য জীবন বেশি দীর্ঘায়িত হয়নি। ১৯৪৮ সালে বিয়ে করেন। চল্লিশ বৎসরের দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করে হৃদরোগ আক্রান্ত হয়ে ১৯৮৮ সালের অক্টোবরে পরলোকে চলে যান স্ত্রী আমেনা বেগম। ঠিক এক বছর পর দ্বিতীয় বিবাহে আবদ্ধ হন তিনি।

তার বড় ছেলে মৃত মো. আতোয়ার হোসেন সান্তাহারে ব্যবসা করতেন। দ্বিতীয় ছেলে মো. আকরাম হোসেন এখন নওগাঁতে ব্যবসা করেন। তৃতীয় ছেলে মো. গোলাম মোস্তফা সুটু সান্তাহারে ব্যবসা করেন। তিনি সান্তাহার গ্রামীণ ফুডসের ব্যবস্থাপক পরিচালক এবং সান্তাহার পৌর যুবলীগের সভাপতি। তার ছোট ছেলে মো. আরফি বর্তমানে প্রবাসী।

সান্তাহার ও আশপাশের র্দীঘ এলাকা জুড়ে আলহাজ্ব আফজাল হোসেন সরদার (আফজাল সাহেব) একজন ভাল মানুষ হিসাবে ব্যাপক সমাদৃত। তিনি একজন দানশীল ও গরীব হিতৈষী বলেও সমাধিক পরিচিত। এলাকার মাদ্রাসা ও মন্দির সমূহে তার অনুদান বিশেষভাবে উলে­খযোগ্য। এলাকার গরীব দুঃখীদের মাঝে সাধ্য মতো তার সহযোগীতার হাত সদা উম্মুক্ত। শিক্ষা ক্ষেত্রে গরীব মেধাবীদের জন্য তার অনেক সহযোগীতার কথা বেশ প্রচলিত। পাঠ্যবই ক্রয় বা পরীক্ষার ফি বাবদ অনেক গরীব ছাত্র-ছাত্রী তার সহানুভূতির ছোঁয়া পেয়েছে। কন্যাদায়গ্রস্থ পিতামাতা বা রোগাক্রান্ত গরীব তার শরনাপন্ন হয়ে বঞ্চিত হয়নি।

রাজনৈতিক অঙ্গনে আফজাল সাহেবের আগমন খুব পুরনো বলা চলে অনেক দিনের। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন এর সময় সান্তাহারে একটি জনসভা হয়েছিল। সেই জনসভায় সে সময়ের দেশের বাঘা বাঘা জাতীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন। যেমন- মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দী । জনসভায় তিনি অগ্রণী ভুমিকা রেখেছিলেন। এমনকি নেতারা জনসভার একপর্যায়ে তেল এবং পেঁয়াজ দিয়ে মুড়ি মাখা খেতে চাইলে তিনি সেটারও আয়োজন করেছিলেন। তিনি সক্রিয় রাজনীতির শুরু করেছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগের সাথে। বঙ্গবন্ধুকে খুব পছন্দ করতেন সেজন্য একপর্যায়ে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হোন। এরপর থেকে নওগাঁ সদর থানার বোয়ালিয়া ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের উপদেষ্টা হিসাবে ছিলেন।

তিনি নওগাঁ সদর থানার বোয়ালিয়া ইউনিয়ের ৩নং ওয়ার্ডের ১৯৬৩ সাল থেকে টানা দশ বছর মেম্বার ছিলেন। তিনি সান্তাহার খ ইউনিয়নে (বতর্মান সান্তাহার পৌরসভা) ১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। বতর্মান সময় বয়সের ভারে তেমন কিছু করতে পারেন না। দোগাছী দঃপাড়া জামে মসজিদ এর ও দোগাছী ঈদগাহ্ কমিটির সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। এক সময় সান্তাহারে কোন কলেজ ছিল না। উনি নিজে পাঁচ বিঘা জমি দেয়াসহ আরো অনেকের সহযোগীতায় মোট ৩৫ বিঘা জমি দিয়ে সান্তাহার কলেজ প্রতিষ্ঠিত করেন। সেটাই আজকের এই সান্তাহার সরকারী কলেজ। তিনি এক টানা বিশ বছর সান্তাহার বি.পি উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ছিলেন। এক টানা পনের বছর স্কুলটি সরকারী হইবার আগে পর্যন্ত সান্তাহার হার্ভে বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ছিলেন। আবার একই সময়ে সান্তাহার কলেজ সরকারী হবার আগ পর্যন্ত ম্যানেজিং কমিটির সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। দোগাছী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতিও ছিলেন।

আফজাল সাহেব একজন শান্ত, ভদ্র বিনয়ী এবং সদালাপী মানুষ। যে কোনো স্তরের মানুষের সাথে তিনি সহজেই খাপ খাইয়ে নিতে অভ্যস্ত। তিনি হাসতে এবং হাসাতে পটু। কারো ভালো কাজে তিনি আনন্দবোধ করেন এবং কাউকে মাত্রাতিরিক্ত স্বার্থপ্রবন দেখলে তিনি বিরক্ত হোন। কারো নৈতিকস্থলনে ব্যাথিত হোন। দৈনন্দিন অবসরে টিভির খবর দেখেন। খবর ছাড়াও আলোচনামূলক অনুষ্ঠান তার প্রিয়।

তিনি মিষ্টি জাতীয় খাবার বেশি পছন্দ করতেন এবং বাসী তরকারিতে পিঁয়াজ মরিচসহ পান্তা অথবা পিঁয়াজ মরিচ ও সরিষা তেলে মাখাবাসী ভাত (কড়কড়ে) তার প্রিয় খাবার। তিনি কেমন মানুষ তা জিজ্ঞাস করা হলে তার সোজা উত্তর, ‘সাধারন মানুষ’ আমার আশেপাশে যারা আছেন তারাই ভাল বলতে পারবে আমি কেমন ছিলাম। এই বয়সে এসেও মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তে ভোলেন না। এখনো তিনি নিজেকে সামাজিক কাজগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে রেখেছেন।

সান্তাহারে বর্ষীয়ান যে কয়জন মানুষ রয়েছেন। রাজনীতি এবং সামাজিক অঙ্গনে যাদের অবদান কখনো ভুলবার নয়। আলহাজ্ব আফজাল হোসেন সরদার তেমনই একজন মানুষ। সান্তাহার তথা অত্র এলাকার মানুষের উন্নয়নে এমন সব মানুষেরই ভীষণ দরকার। আমরা তার দীর্ঘ জীবন এবং সুস্বাস্থ্য কামনা করছি।

লেখক :: ইঞ্জিনিয়ান এস এম রায়হানুল ইসলাম (রায়হান)

সান্তাহার ডটকম/১৭ জুন ২০২০ইং/ইএন